টাইমস বাংলা ডেস্ক -প্রাণবন্ত পড়ুয়ারা ছিল। তাদের নানা প্রশ্নও ছিল। সহকর্মীদের উচ্ছ্বাস ছিল। কমনরুমের বৈঠকও ছিল। ক্যান্টিনের আড্ডা ছিল। আবার ফিরে দেখার টানও ছিল। বহুদিন পর তিনি এলেন। পুরনো সেই দিনের কথায় অতীতকে ছুঁয়ে গেলেন। অনাবিল আড্ডায় হাসলেন, হাসালেন। চলার পথের সঙ্গীদের চিনে খোঁজ নিলেন। প্রিয় পড়ুয়াদের আগামীর সুলুক দিলেন। এবং উড়ে আসা প্রশ্নের জবাবে আশা আর ভরসা জুগিয়ে গেলেন লাগাতার। রাজা রামমোহন রায় সরণির সাবেক খিলানওয়ালা সেই বাড়িতে নিত্য আনাগোনায় তিনি নিজেই ইতি টানলেন বুধবার। সিটি কলেজের অ্যাটেনড্যান্স রেজিস্টারে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে শেষবারের মতো সই করে স্বেচ্ছাবসরের আবেদন জমা দিলেন ব্রাত্য বসু।
কর্মজীবন শেষ হওয়ার এক দশকেরও বেশি আগে প্রাক্তন অধ্যাপকের তকমা আপন করে নিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। সহকর্মীরা অনুরোধে মুখর, এখনই বিদায় বোলো না…! পড়ুয়ারা নাছোড়, যাবেন না স্যর। কিন্তু ব্যস্ত মন্ত্রী তথা বিদায়ী অধ্যাপক অনড়, “আমি তো আসতে পারি না। পড়ুয়াদের ক্ষতি হচ্ছে। শুধু শুধু জায়গা আটকে থাকব কেন? বরং নতুন কেউ আসুক, ছাত্রছাত্রীদেরও সুবিধা হবে।”
১৯৯৬ থেকে ২০২২। সিটি কলেজের সঙ্গে টানা পঁচিশ বছরেরও বেশি সময়ের অটুট বন্ধন অবশেষে ছিন্ন করলেন ব্রাত্য। ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর থেকেই তৃণমূল চালিত রাজ্য সরকারের মন্ত্রী তিনি। ছুটিতে থাকায় কলেজে যাতায়াত আর আগের মতো নিয়মিত না থাকলেও যোগাযোগের সুতোটা কখনও একেবারে ছিঁড়ে যায়নি। বুধবার বহুদিন পর কলেজে ফিরলেও তাই তিনি নিমেষেই সবার আপনজন। সহশিক্ষকদের সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পাশাপাশি বাড়ির খোঁজ পর্যন্ত নিতে ভোলেননি। অশিক্ষক কর্মীদের একজনেরও নাম ভোলেননি দেখে তো তাঁরা নিজেরাই অবাক! আবার অ্যাকাউন্টস বিভাগের সকলেরও খুঁটিনাটিও এখনও যেন নখদর্পণে। সহকর্মীদের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ গড়ে না উঠলে কি এমনটা আদৌ সম্ভব! তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাসের আবহে কানাঘুষোয় এমনই বিস্ময় উগরে দিচ্ছিলেন অনেকেই। দোতলায় কমনরুমের মাঝ বরাবর যে চেয়ারে বসতেন, মন্ত্রীর তথাকথিত প্রোটোকল এড়িয়ে বুধবারও ব্রাত্য দিব্যি স্বচ্ছন্দ সেখানেই। ক্লাসে তুখড় যে মানুষটিকে সমান দাপটে মঞ্চও মাতাতে দেখেছেন সহ-শিক্ষক থেকে শুরু করে পড়ুয়ারাও, তার স্মৃতিও যে রীতিমতো অমলিন বুধবার তারও সাক্ষী থাকলেন তারা। ব্রাত্য যতদিন নিয়মিত কলেজ করেছেন ক্যান্টিনের কর্মী সঞ্জয় তখন নেহাতই ছোট। এদিন ‘ব্রাত্য স্যর’ আসার খবর পেয়ে সঞ্জয়ও হাজির। আর কী আশ্চর্য, তাকে চিনতে কোনও ভুল করলেন না ‘বি বি’ (কলেজের পড়ুয়ামহল এই নামেই চেনে তাকে)!
কমনরুমে বসে সহকর্মীদের সঙ্গে নিখাদ আড্ডায় গভীর আলোচনা থেকে মিঠে খুনসুটি কিছুই বাদ গেল না। দেখে কে বলবে যে শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং হাজির কলেজের টিচার্স রুমে! অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণার দিনে মন্ত্রিসুলভ গাম্ভীর্য থেকে শুরু করে তামাম আনুষ্ঠানিকতাই হেলায় উড়িয়ে এদিন ব্রাত্য আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিলেন কলেজের শিক্ষকমহলের একজন।একই ভবনে সকালে চলে রামমোহন কলেজ। সিটি ছাড়ার দিনে রামমোহন কলেজের অধ্যক্ষ শাশ্বতী সান্যালের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে আসতে ভোলেননি বিদায়ী অধ্যাপক তথা মন্ত্রী।
ছিয়ানব্বইয়ের ডিসেম্বরে সিটি কলেজের বাংলা বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন ব্রাত্য বসু। সাহিত্য আর নাটকের অলিগলিতে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণের সাহচর্য পেতে একসময় পড়ুয়াদের তাঁর ক্লাস মিস না করার প্রবণতার কথা এখনও কান পাতলেই শোনা যায় কলেজে। পড়ানোর পাশাপাশি মঞ্চেও তাঁর স্বাতন্ত্র্য নয়া মাত্রা পেয়েছিল এই পর্বেই। মঞ্চে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার দলিল তাঁর ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ যখন বাংলা কাঁপাচ্ছে, সিটি কলেজের ক্লাসরুমে তখন পড়ুয়া মননের আঁধারে আলো জ্বালাতেও তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। দেবব্রত বিশ্বাসের জীবন নিয়ে ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর বাস্তবতায় তামাম বাংলা তোলপাড় করার দিনগুলিতেও এই সিটি-তেই ব্রাত্য থেকেছেন সহকর্মী থেকে শুরু করে পড়ুয়াদের সমান সুহৃদ।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের আবহে কণ্ঠ ছেড়েছেন, আবার অন্য কালের ভোরের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থেকেই শিক্ষাদানের ব্রতও পালন করে গিয়েছেন নিষ্ঠাভরে। ২০১১-তে পালাবদল পর্বে ২০ মে তিনি লিয়েনের আবেদন করেন। রাজ্যের নয়া তৃণমূল সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর প্রথম লিয়েন তথা দীর্ঘকালীন ছুটি মঞ্জুর হয় ২০১৬ সালের ২৬ মে পর্যন্ত। দ্বিতীয় পর্বে কলেজে তাঁর ছুটি মঞ্জুর হয় ২০২১ সালের ২৬ মে অবধি। তার পরও বিধি মেনেই দীর্ঘ ছুটির আবেদন করেন রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্যতম এই সদস্য। সেই আর্জি মঞ্জুরও হয়েছিল। তার মাঝেই এবার স্বেচ্ছায় কলেজ থেকে পাকাপাকি ছুটি নিয়ে নিলেন মাননীয় মন্ত্রী।
বহুদিন পর তাঁকে কাছে পেয়ে বুধবার সহকর্মীরা কেউ খোঁজ নিলেন তাঁর নাট্যচর্চার। কারও কথাবার্তায় উঠে এল অ্যাকাডেমিক নানা প্রসঙ্গ। কেউ আবার চলচ্চিত্রেও তাঁর সফল ভূমিকার প্রশংসায় হলেন পঞ্চমুখ। কলেজের এখনকার পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা রাজ্য বিধানসভায় শাসকদলের মুখ্যসচেতক তাপস রায়, অধ্যক্ষ শীতলপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-সহ সমিতির সদস্যরাও এদিন এসেছিলেন ব্রাত্যর বিদায় সংবর্ধনায়। পুষ্পস্তবক তুলে দেন তাঁরা। কলেজের অশিক্ষক কর্মী ও ছাত্র সংসদের তরফেও বিদায়ী অধ্যাপককে এদিন সংবর্ধিত করা হয়।
অধ্যাপক ও কলেজের অধ্যক্ষ শীতলপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “চারতলায় ছিল আমাদের বোটানি ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু বেশ মনে পড়ে কমনরুমে বহু গল্প, আড্ডা হত ব্রাত্যবাবুর সঙ্গে। তাঁর মতো মানুষকে আর কলেজে পাব না, এটা আমাদের ক্ষতি সন্দেহ নেই। তবে তিনি তো আমাদের গর্বও বটে। আমরা নিশ্চিত কলেজের স্বার্থে তাঁর অকুণ্ঠ সহযোগিতা মিলবে বরাবরই।” কলেজের এখনকার পড়ুয়ারা প্রায় সকলেই তাঁর অপরিচিত। কিন্তু পরম স্নেহে কাছে ডেকে কলেজের চৌকাঠ ডিঙোনোর পর তাদের নয়া উড়ানের দিশাও এদিন চিনিয়ে দিলেন ‘ব্রাত্য স্যর’। হাত বাড়ালেই মন্ত্রী স্বয়ং।
তাই একাধারে অভাব-অভিযোগ এবং আবেদনও উঠে এল একাধিক– অশিক্ষক কর্মীর সংখ্যা কলেজে কমতে কমতে তলানিতে। বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। হস্টেল চালু করার মতো আরও একাধিক কাজ এখনও ঝুলে। এই সব বিষয়ই নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করে তাঁর দপ্তরে জমা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ব্রাত্য। কলেজের অধ্যাপক থেকে পড়ুয়া সবাই নিশ্চিত, কথা রাখবেন মন্ত্রীমশাই।