‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা!’
না, করোনা-কালে সেটা সম্ভব নয়। গোঁফ দেখবেন কী করে, সেটি তো অনু-মুখোশে ঢাকা। মাস্ক-ই তো বঙ্গজীবনে মাস্ট হয়ে বসে রয়েছে অষ্টপ্রহর! ফলে রমণীর ঠোঁট সৌন্দর্যায়ণও এখন অযত্নে লালিত। এবং অশোভিত। সাহিত্য ঠাঁই নিয়েছে বই থেকে মুঠোফোনে। অণু থেকে পরমাণু! চলছে ঘরে ঘরে সাহিত্য-চর্চা এবং ছবি তোলার পারদর্শীতার অণু-প্রতিযোগিতা। সামাজিক গণমাধ্যমে প্রতিভার বিচ্ছুরণ তো রয়েইছে, আরও অনু পরিসরে উঠে আসছে সাহিত্য। কলকাতায় বা গ্রাম বাংলায় চোখ মেললেই দেওয়াল পত্রিকার বদলে, ছেলে-মেয়েদের বুকে-পীঠে ফুটে উঠছে সেই সাহিত্য! বাঙালির টি-শার্টের কল্যাণে ‘বুক-সাহিত্য’ বেশ জমজমাট।পীঠেও আছে। এপার এবং ওপার দুই বাংলাতেই টি-শার্টের সঙ্গেই ছেলে এবং মেয়েদের কাছে ‘বুক এবং পীঠ সাহিত্য’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গোটা দুনিয়াতেই অবশ্য বার্তা বহণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে টি-শার্টের নরম জমি। এটাকে আদৌ সাহিত্য বলা যায় কিনা সেটা বুদ্ধিজীবীদের বিচার্য বিষয়।
কিন্তু রাস্তাঘাটে শোভনীয় ও অশোভনীয়, শালীন ও অশালীন, অর্থবহ এবং অর্থহীন বুক আর পীঠের বাহার চোখে পড়বেই। দৃশ্য দূষণ বা দৃষ্টিনন্দন যে শিরোনামেই নামকরণ হোক না কেন, করোনা-কালেও টি-শার্ট শোভিত নগর ও গ্রাম জীবনে এটাই বাস্তব ছবি।
‘খেলা হবে’ দেখতে দেখতে হঠাত ধর্মতলায় কেসি দাশের সামনে সেদিন চোখ গেলো কুচকুচে দাড়িওয়ালা ঝোলা-কাঁধে সাতের দশকের তারুণ্যে ভরপুর এক যুবকের পীঠে। জিন্সের ওপর সা্দা টি-শার্টে লাল তারার নীচে লেখা, ‘দম রাখো, খেলা ঘুরবে’। সেদিনই কলেজ স্ট্রিটের এক তরুণীর বুকে কালোর ওপর লাল-হলুদে জ্বলজ্বল করছে, ‘তবে তাই হোক’! ক-দিন আগে, শোভাবাজারে এক তরুণীর পীঠে লেখা, ‘আমি বাংলায় কথা কই’।আসানসোল শহরে ‘খাঁটি বাঙালি’ রয়েছেন সপ্রতিভ এক তরুণের বুক জুড়ে। আবার বর্ধমানের কিছু যুবকের, ‘চারিদিকে করোনা মাস্ক পরতে ভুলোনা’ তো খবরের কাগজের শিরোনামে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে অমর একুশের আগে দেখা যায়, ভাষা শহিদদের স্মরণে অসাধারণ কিছু বুক ও পিঠ শিল্পকর্ম। কারও বুকে শুধুই ‘অ-আ-ক-খ’, কারও বা পীঠে, ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’! অথবা, বাংলা নববর্ষে, ‘মনের কথা, মনেই থাক। শুভ নববর্ষ’
এমনকী, করোনাকালে দেখা মিলেছে, তরুণীর বুকে, ‘গা ঘেঁসে দাঁড়াবেন না’। ‘পেটুক’ বাঙালির ‘বর্ণপরিচয়’ থেকে শুরু করে ‘ধুস্ ভাল্লাগে না’, আমার ব্যাপারটা একটু আলাদা’ লেখা থাকে বুকের ওপর ‘মেড ইন বাংলা’।
কলকাতার বুকে ইদানিং প্রায়ই দেখা মেলে, ‘ধোঁয়া তুলসি পাতা’। কোনও অষ্টাদশীর হার্টে গর্জে ওঠে ইংরেজিতে, ‘হার্টব্রেকার’। কেউবা, ‘আই অ্যাম অওসাম’! বুকে স্বচ্ছন্দ ঘোষণা, ‘বি অ্যাস ইউ উইশ টু বি সিন’! কারও বুকে প্রশ্ন বাংলাতেই, ‘খাবি কি’। কেউবা বলতে চান, ‘ইটস নট মি, ইটস ইউ’। হৃদয় থেকে উতসরিত ইংরেজি বর্ণমালায় শোভিত, ‘সি ও ও এল’ অথবা ‘জি ও এ এল’। আসলে বাঙালির তরুণ বুকে আজ ‘অল আউট অফ লাভ’! ভালো-খারাপ যা দেবে অঙ্গে, সবই পাওয়া যায় দুই বঙ্গে! এখনও বাংলা গণমাধ্যমে ছাপার অযোগ্যও কিছু ইংরেজি শব্দও শহরে চোখ মেললে দেখা যায় বুকে-পীঠে। তরুণ প্রজন্ম বেপড়োয়া, অর্থ বুঝেই হোক বা না বুঝে, ইংরেজি অর্থহীন উন্মাদনার স্মারক এখন আমাদের অমরসঙ্গী হয়ে উঠেছে। তাই নিয়ে কলকাতা বা গ্রাম বাংলা আলোকিত করে চলেছে করোনাকে বশ করে রাখা টি-শার্ট প্রেমী মাস্ক-শোভিত হাল ফ্যাশন। তাই রবিবার পার্টি স্ট্রিটে তরুণীর বুক বাংলাতেই জানান দেয়, ‘আসছে উইকেন্ড আবার খেলা হবে’। আবার শান্তিপুরের কলেজ পড়ুয়ার বুক বলে, ‘নো এন্ট্রি’। তবু টালিগঞ্জে মেট্রোর থেকে বেড়িয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যাওয়া তরুণীর পীঠ বলে দেয়, ‘চেয়ে থাকি’।
মুখ ঢাকা মুখোশে, তাই বুক আর পীঠই বলে চলেছে, কিছু কথা। কিছুটা জেনে, কিছুটা না জেনেই। রঙের বাহারে টি-শার্ট হয়ে উঠছে কখনও কখনও মুখোশে ঢাকা মুখগুলির মুখছবি। অথবা হারিয়েও যাচ্ছে মুখ বুকে আর পীঠে। সত্যিই কি জরুরি বুক আর পীঠে এমন রচনা, প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু জবাব না দিয়েই ব্যস্ত সময় আরও বেশি করে দিওয়াল লিখন ঠিক করে নিচ্ছে। আসলে তো ‘খেলা শুরু বুক দুরুদুরু’