মাধুরীর কথা
রাজা চ্যাটার্জী, চিত্র পরিচালক
দুই মেয়ে – বড় মেয়ে মঞ্জু আর ছোট মেয়ে মাধুরী। মা লীলাদেবী তাদের নিয়ে যেন অথৈ সাগরে পড়লেন। বাবা আইনজ্ঞ শৈলেন মুখোপাধ্যায় তাদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। তিনি অন্যত্র ঘর বেঁধেছেন। সাতচল্লিশের দাঙ্গার সময় সহায়-সম্বলহীন এই পরিবার ভেসে বেরিয়েছে আজ এই আত্মীয়, কাল ওই আত্মীয়র বাড়িতে বাড়িতে। আত্মীয় স্বজনের অবজ্ঞা, অবহেলা আর তাচ্ছিল্য অনুভব করতো ছোট্ট মাধু। লীলা দেবী গান জানতেন। গান শিখে গেল দুই বোন। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে গান গাইবার কাজ জুটলো।
একজন ভদ্রলোকের দয়ায় একটি মাথাগোঁজার ঠাঁই হল। ভদ্রলোক ভাড়া-টারা কিছুই নিতেন না এই অসহায় পরিবারটি থেকে। তবে প্রতিবেশীদের সন্দিহান চোখ তাদেরকে একঘরে করে রেখেছিল। মা গান গেয়ে ক’পয়সাই পেতেন। প্রবল অর্থকষ্ট। কিন্তু দুঃখকে সঙ্গী করাতে সংবেদনশীল হয়েছে মাধুর মন। ফলে সুখ-দুঃখ রাগ অভিমান সকল অনুভূতি তার মুখে ধরা পড়তো আয়নার মত।
এরপর শ্রীরঙ্গম নাটকের অভিনয়। কিন্তু মাধু সেই অর্থে দেখতে ভালো নয়। সে বেঁটে, তাঁর দাঁতের গঠন ঠিক নয়, চোখও সামান্য কোটরাগত; তবুও লড়াই চালিয়ে যেতে লাগলো এই ছোট্ট মেয়েটি। অবশেষে প্রথম ছবি তপন সিংহের ‘টনসিল’। অবশ্য তখনও মেয়েটির নাম মাধুরী।
সে সময় পরিচালকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সুযোগের আশায়। গেছিলেন ঋত্বিক ঘটকের কাছে। ঋত্বিক ঘটক তাঁকে দেখেই নাকচ করে দিলেন। বলেছিলেন, “মাধূ, তোর যা চেহারা দেখলেই মনে হয় সুতিকা রুগী।” (অবশ্য পরে তাঁকে নিয়ে ছবি করেছিলেন, সুবর্নরেখা)
তবে মনের অদম্য জেদ তাই দমে যায়নি সে। একদিন মৃণাল সেন ডেকে পাঠালেন। মৃণাল সেন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন অদ্ভুত সব প্রশ্ন, “তুমি ঘর মুছতে পারো? তুমি বাসন মাজতে পারো? কাপড় কাচতে পারো? ঘুটে দিতে পারো?”
সব কথাতেই মাধুরী বলেছিল, “হ্যাঁ।”
তবু পরিচালক কেমন খুঁতখুঁত করছিলেন। এই সময় তার বাড়ির বৃদ্ধ কাজের লোক বলেছিল, “আহারে, মেয়েটিকে দেখলে বড় মায়া হয়। কাজের লোকটির এই কথাতেই সম্ভবত পরিচালক তাঁকে সুযোগ দিলেন। তবে নাম বদলে দিলেন ‘মাধবী’। ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’।
মৃণাল সেন তাকে শেখালেন সিনেমার অভিনয়। যেমন একদিন বললেন, চোখের দিকে চেয়ে থাকতে, খবরদার চোখের পাতা যেন না পড়ে। আসলে ক্লোজ শটে চোখ পিটপিট করলে ভীষণ খারাপ লাগে তো, তাই এইভাবেই দিয়েছিলেন চোখ খোলা রাখার ট্রেনিং।
‘বাইশে শ্রাবণ’-এর শুটিং হয়েছিল বর্ধমানের মানকরে। সেখানে কলাকুশলী সবাই থাকতো একটা ভুতুড়ে বাড়িতে। সেই বাড়িতে ছিল অসংখ্য সাপ। যে পুকুরে ছবির একটি দৃশ্য ছিল যে মেয়েটির স্নান করছে, সেখানে থিক ঠিক করছিল পোকা আর সাপ।
৩০ শে জুন, ১৯৫৯ – নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ী মারা গেলেন। দিনটা বিষণ্ন, মেঘাচ্ছন্ন। শিষ্যা মাধূ তাঁর বাড়িতে গেলেন শেষ প্রণাম জানাতে। বাড়ির সামনে দেখল, একজন লম্বা লোক অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন আর ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছেন। কে যেন বলল, উনি ‘পথের পাঁচালী’-র পরিচালক সত্যজিৎ রায়।
নাট্যাচার্যের মরদেহ এল। বেশ ভিড়। মাধূ দেখল লম্বা লোকটি একটি গাছে উঠে ক্যামেরায় ছবি তুলছেন।
বছর দুয়েক বাদে ডাক এল। মাধু গেল লেক টেম্পেল রোডের বাড়িতে। সত্যজিৎ তখন ‘অভিযান’ ছবির শুটিংয়ে ব্যস্ত। প্রথমদিন বিশেষ কথা হলো না। কিন্তু এরপর সত্যজিৎ তাকে শুধু ছবিতেই নিলিনই না, সত্যজিৎ রায়ের নায়িকা বলতে তাকেই বোঝায় – মাধবী মুখোপাধ্যায়কে।
মহানগর (১৯৬৩) চারুলতার (১৯৬৪) এবং কাপুরুষ মহাপুরুষ (১৯৬৫)। সত্যজিতের নিজের ভাষায়, “অসাধারণ অভিনেত্রী। খুব বুদ্ধিমতি। অসম্ভব সেনসিটিভ অভিনেত্রী। চট করে একটা চরিত্রকে বুঝে নিতে পারে। কোন চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করতেও পারে খুব সহজে। আমার তিনটে ছবিতে মাধবী অভিনয় করেছে। ওর পেশাদারী দক্ষতা স্বীকার করতেই হবে। ও আমার ছবিতে যা কিছু করেছে, নিজের থেকেই করেছে। আমায় বিশেষ কিছু করতে হয়নি।”
(তথ্যসূত্র: আনন্দলোক এর একটি সাক্ষাৎকার ও প্রসাদ)