দীপাবলি ও দিওয়ালি: আলোর উৎসব, উৎসবের আলো
অধ্যাপক সুজয়কুমার মণ্ডল
বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক
লোকসংস্কৃতি বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
কথায় আছে ‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’। এখন পার্বণের সময়। উৎসব পালনের সময়। আনন্দ করার সময়। আনন্দ ব্যতীত আমাদের পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। আমরা সব সময় চাই আমাদের জীবন আনন্দময় হয়ে উঠুক। সুখ, শান্তি, জ্ঞান ও সম্পদ প্রাপ্তির জন্য দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো হয় দিওয়ালি বা দিপালী বা দীপাবলি বা দীপান্বিতা উৎসবে। মানুষ অশুভ, অকল্যাণের প্রতীক অন্ধকারকে সরিয়ে শুভ ও কল্যাণের আশায় প্রায় সারা দেশজুড়ে দীপাবলি বা দিওয়ালি উৎসব পালিত হয়। সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনাই এই উৎসবে মূল লক্ষ্য। কিছু কিছু অঞ্চলে লক্ষ্মী-গণেশের পূজারও চল রয়েছে। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অমাবস্যা তিথিতে আলোর উৎসব দিওয়ালির সূচনা হয়। এই উৎসবের সূচনা সম্পর্কে পৌরাণিক অনুষঙ্গগুলিও বেশ আকর্ষণীয়। পুরাণে বলছে আশ্বিন মাসের নরক চতুর্দশীর দিন ভগবান বিষ্ণু নরাসুরকে বধ করেন এবং বসুন্ধরা সৃষ্টি করেন। সেজন্য নতুনকে স্বাগত জানাতে মানুষ তার গৃহকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সারি সারি প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকময় করে তুলে। অন্যদিকে পুরাণ অনুসারে দেখা যাচ্ছে, অসুর রাজা বালি বছরে একবার করে পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে বাইরে আবির্ভূত হন আর সেই দিনই কেরালায় ওনাম উৎসব পালিত হয়। আর উত্তর ভারত সহ অন্যান্য অঞ্চলে দিওয়ালি উৎসবের সূচনা ঘটে। এই সময়ে দেবী লক্ষী গৃহে প্রবেশ করেন। মানুষ সম্পদ ও সমৃদ্ধির আশায় তাঁর আরাধনা শুরু করে। এক্ষেত্রে একটি আশ্চর্যজনক বিষয় হল কৃষি উৎসবের সঙ্গে অসুর বধ বা মৃত্যুর সম্পর্ক। দশেরায় দেবী দুর্গার কাছে মহিষাসুর বধ হয়। অন্যদিকে দেওয়ালির সময় বিষ্ণুর কাছে নরকাসুর এবং অসুর রাজা বালি বধ হয়। আবার কৃষ্ণের কাছে নরকাসুর বধ হয়ে বলে মত রয়েছে। সঞ্জীবনীবিদ্যা অনুসারে অসুরকুল বসুন্ধরার উর্বরতা রক্ষা করে। সেইজন্যে দেখা যায় অসুর বধ আর ফসল কেটে ঘরে তোলা, আর এর মাধ্যমে আবার বসুন্ধরাতে নতুন কৃষিকাজের সূচনা ঘটে। বিষয়টি বেশ তাৎপর্যময়। সার্বিক প্রেক্ষিতে বলা যায় Fertility cult বা উর্বরতা তন্ত্রের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে সম্পর্ক রয়েছে।
মহালয়ার সঙ্গেও দীপাবলীর সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। শ্রী যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর রচিত ‘পূজা-পার্বণ’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: “অমান্ত ভাদ্রঅমাবস্যা মহালয়া। সেদিন পিতৃশ্রাদ্ধ করিয়া পিতৃগণকে দীপ দেখাইতে হয়। অন্ধকার যমলোক হইতে তাহারা পিতৃযানপথে মহা-আলয়ে গমন করেন। সেই কারণে মহালয়া দীপান্বিতা অমাবস্যা। সেদিনও লক্ষ্মীপুজো করিতে হয়। বঙ্গের গ্রামবাসী জানে, কেন সেদিন দীপদান ও ইঁজল-পিঁজল করে। পশ্চিম ভারতে গুজরাট ও বোম্বাই প্রদেশের লোক জানে না। তাহারা কার্তিক-শুক্ল প্রতিপদে নূতন বৎসর গণে। এই কারণে মনে করে, দিপালী নববর্ষের পূর্ব রাত্রির উৎসব।” কাজেই একই উৎসব বিভিন্ন প্রদেশে ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। গুজরাটে দেওয়ালির সময় ধনতেরস পালিত হয়। অনেকে মনে করেন ধনত্রয়োদশী থেকেই ধনতেরস কথাটি এসেছে। এদিন গৃহ সম্পদ হিসেবে সোনা সংগ্রহ করে। ধনতেরস সম্পর্কে ভিন্ন তথ্যও প্রচলিত রয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে, ধন্বন্তরী নামে কাশীতে এক রাজা ছিলেন। তিনি তাঁর রাজত্বের বাইরে গিয়েও আয়ুর্বেদ চর্চা করেন। মনে করা হয় তার প্রচারেই আয়ুর্বেদ আমাদের দেশে এত প্রসিদ্ধ। তিনি ত্রয়োদশী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেন তাই তখন থেকেই আয়ুর্বেদ অনুরাগীরা তাঁর জন্মতিথি ধন্বন্তরী ত্রয়োদশী হিসেবে পালন করে। হিন্দিতে ধন্বন্তরি তেরস বা সংক্ষেপে ধনতেরস বলে। আরো মনে করা হয় এই ধনতেরসের সঙ্গে সোনা সংগ্রহ বা কেনার কোন সম্পর্ক নেই। ধনতেরাস সোনার গয়না নয়, আয়ুর্বেদ ঔষধ কেনার দিন। ধন্বন্তরি জন্মেছিলেন ত্রয়োদশী তিথিতে শেষ লগ্নে ও চতুর্দশীর শুরুতে। তাই ধন্বন্তরীর মত আয়ুর্বেদাচার্যকে মর্যাদা দিতে চতুর্দশী তিথিতে বিশেষ পুষ্টিযুক্ত শাক খাওয়ার চল শুরু হয় শীতের শুরুতে। অনেকে মনে করেন এটি একটি প্রাকৃতিক প্রতিষেধক। নানা ধরনের রোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। যাইহোক ধনতেরস নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে। এবারে আবার দিওয়ালির কথায় আসি।
মূলত হিন্দু, শিখ, জৈন সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে দিওয়ালি উৎসবের প্রচলন সবচেয়ে বেশি। তবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও সাড়ম্বরে এই উৎসব পালনের রীতি লক্ষণীয়। দিওয়ালি উৎসব কিভাবে শুরু হয়েছে এ নিয়ে যেমন অজস্র পৌরাণিক অনুষঙ্গ রয়েছে তেমনি রয়েছে লৌকিক জনশ্রুতি বা কিংবদন্তি। যেমন একটি জনশ্রুতিতে বলা হচ্ছে, অযোধ্যাতেই প্রথম দিওয়ালি উৎসব পালন করা হয়। রামচন্দ্র, লক্ষণ, সীতা ও হনুমান যখন রাবণ বধ করে অযোধ্যাতে ফিরে আসে তখন বিজয়ের মুহূর্তকে স্মরণীয় ও উপভোগ্য করে তুলতে ঘি দিয়ে মাটির প্রদীপ সারা দিনরাত জ্বালিয়ে রেখেছিল। সেই থেকেই মানুষ রামের বিজয় এবং রাবণের পরাজয় হিসেবেই এ দিনটিকে দেখে এবং প্রদীপ জ্বালিয়ে অশুভ শক্তির বিতাড়ন করে। কামনা করে শুভশক্তির, যা মঙ্গলদায়ক।
বাংলায় অশুভ শক্তির বিতাড়ন করে শুভশক্তির সাধনা করে শ্যামা পূজা বা কালীপূজায়। শুধু বাংলা কেন বিভিন্ন রূপে ও বিভিন্ন নামে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশেও কালী পূজা হয়। এ নিয়ে এখানে আলোচনা না করে বাংলাতে কালীপুজোর সময় দিপালী বা দীপান্বিতা বা দীপাবলীর যে উৎসব পালিত হয় তা নিয়ে একটু আলোকপাত করব।
গৌরবর্ণা দেবী গৌরী হলেন গৃহী, আর কৃষ্ণবর্ণা দেবী শ্যামা হলেন বন্য। প্রসঙ্গক্রমে বাংলার মৌখিক ঐতিহ্যে প্রচলিত দুটি জনশ্রুতির কথা উল্লেখ করব। প্রথমটি হলো, পৃথিবী যখন দূষিত হয়ে উঠেছে। ভরে উঠেছে দুর্নীতিতে। তখন দেবী কালী যারা পৃথিবীর বোঝা হয়ে উঠেছে তাদের মুণ্ডচ্ছেদ করতে শুরু করেন। পান করেন রক্ত। মুণ্ডমালা গলায় পরিধান করেন। দেবী কালীর মুণ্ডচ্ছেদ চলতেই থাকে। একসময় তাঁর চলার পথে শিব তাঁর অপরূপ শোভা নিয়ে শুয়ে পড়ে। কালী শিবের শরীরের উপরে দাঁড়িয়ে পড়েন। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে শিবের রূপের অপরুপ সৌন্দর্য। কালীর ক্রোধ ক্রমশ কমতে থাকে। অবশেষে হিংসা ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়। তারপর শিব ও কালী মিলে পৃথিবীর রূপান্তর ঘটায়। পৃথিবী হয়ে ওঠে দূষণমুক্ত ও দুর্নীতিহীন বসুন্ধরা। এখানেও আমরা বাইনারি বা পারস্পরিক বৈপরীত্য দেখতে পাই।
আরেকটি গল্পে রয়েছে, পৃথিবী যখন আবার দূষিত হয়ে উঠলো, ভরে গেল দুর্নীতিতে তখন কালী আবির্ভূত হলেন। তিনি তাঁর রূপ বদলে কৃষ্ণ রূপে পৃথিবীতে এলেন। কিন্তু শিব কালী ছাড়াতো থাকতে পারেন না। তখন শিব গৌরবর্ণা রাধা রূপে কৃষ্ণের সামনে আবির্ভূত হলেন। শিব বলেন – “যখন তুমি কালী রূপে থাকবে তখন তুমি আমার উপরে থাকবে, আর যখন তুমি রাধা রূপে থাকবে তখন আমি তোমার উপরে থাকবো”। এরপর কৃষ্ণ বাঁশি বাজাতে থাকে আর রাধা তাঁর চারিপাশে নাচতে থাকে। পুরাণতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ দেবদত্ত পট্টনায়েক জানাচ্ছেন, এই ধরনের কাহিনিগুলির মধ্যে ধর্মীয় থাক বা উপবিভাগ, লিঙ্গ, যৌনতা ও বর্ণের দ্বান্দ্বিক রূপ আমরা দেখতে পাই। আমরা সকলেই জানি তান্ত্রিকতা, তান্ত্রিক সাহিত্যে ও শাক্ত-চর্চায় নারী সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। দেবী হয়েছেন আরাধনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। কামসূত্র অনুসারে যৌন মিলনের সময় নারী-পুরুষের উপরে থাকে যখন সে গর্ভধারণ করে। যাইহোক, ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে কৃষ্ণবর্ণ বসুন্ধরা বা পৃথিবীর সঙ্গে সমরূপ হিসেবে দেখা হয়, অন্যদিকে গৌরবর্ণ গৃহ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে দেখা হয়। কৃষ্ণবর্ণা কালী বন্য আর গৌরবর্ণা গৌরী গৃহদেবী। গৃহদেবতা বিষ্ণুও কালো, অন্যের দিকে নির্জনবাসী সন্ন্যাসী শিব ফর্সা। আবার কৃষ্ণও কালো, রাধা হলো ফর্সা। মা শ্যামা হলেন: “কালো রূপে দিগম্বরী/হৃদি পদ্মে করে মোর আলোরে”।
এভাবে নানান দ্বান্দ্বিকতার কথা উল্লেখ করা যায়। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণে পরিপ্রেক্ষিত ও ব্যাখ্যা করা যায়। তত্ত্ব আর ব্যাখ্যার ভার না বাড়িয়ে এবার মূল আলোচনাটি শেষ করি।
আলোর উৎসবের মাধ্যমে যেমন অন্ধকার দূরীভূত হয়, তেমনই দূরীভূত হয় অজ্ঞতা। শ্যামা পূজার সময় দীপাবলি অন্ধকার দূর করে আতশবাজি ও আলোকমালা বসুন্ধরাকে ভরিয়ে তোলে। এককথায় দীপাবলি আমাদের কাছে আলোর উৎসব; ঠিক একইভাবে তা আমাদের কাছে উৎসবের আলো। আমাদের কাছে যা দীপাবলি, অবাঙালিদের কাছে তাই-ই দিওয়ালি। দীপাবলি আনন্দের উৎসব, আলোর উৎসব, প্রাণের উৎসব; এ জীবনের উৎসব: “মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”। শুভ দীপাবলি…
কৃতজ্ঞতা: ড. শক্তিনাথ ঝা, ড. অর্জুন সেনশর্মা, শ্রীমতি অঞ্জনা ঘোষ মন্ডল, শ্রী দেবদত্ত পট্টনায়েক প্রমূখ