ঝাড়গ্রাম – কনক দুর্গা – ডুলুং নদী
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়, পর্যটক বিশেষজ্ঞ
যে মাটির রং এমনিতেই লাল । সেখানে কেন রক্তের দাগ ? শুধু রক্তের দাগ নয় ! সে রক্ত গিয়ে মিশবে ডুলুং নদীতে । কনক দুর্গা মন্দিরে গিয়ে এমন ইতিহাস শুনে বড় বিস্ময় লাগে । জঙ্গল মহলে দাঁড়িয়ে ভাবি আজ থেকে ৫০০ বছর আগে রাজা গোপীনাথ মন্দিরটি নির্মাণ করেছেন । রাজা স্বপ্নে কনক দুর্গার মূর্তি দেখেন এবং দেবীর মন্দির তৈরি করেন। নাম অনুসারে কনক, মূর্তিটি সম্পূর্ণরূপে সোনার তৈরি এবং উচ্চতায় ২(দুই) ফুট। এটা বিশ্বাস করা হয় যে রাজকীয় আমলে মানব বলিদান একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার তৈরি করেছিল। যতক্ষণ না বলির রক্ত ডুলুং নদীতে পৌঁছায়, আচার চলতে থাকে। জঙ্গলমহলে আমরা প্রকৃতি দেখতে এসছি । যে জঙ্গলমহলের বুকে একদিন রক্তের বন্যা বয়ে গিয়েছিল,সে জঙ্গলমহল এখন সেজেছে নতুন সাজে । রাজা আছেন , রাজবাড়ী আছে, সব আছে কিন্তু কোন ভয় নেই, কোন আতঙ্ক নেই । নির্ভয়ে তিন দিন কাটিয়ে আসা যায় ঝাড়গ্রামকে কেন্দ্র করে ।
আমাদের ঝাড়গ্রাম ভ্রমণ করতে শিখিয়ে দিলেন আমার ভাতৃপ্রতিম বন্ধু ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র কুন্তল দে । এই ভ্রমণ করতে আসার আগে আমার বন্ধু অরিন্দম দত্ত (মিন্টু দা) যাকে বলা হয় ঝাড়গ্রাম পর্যটনের দিশারী ও বন্ধু সাংবাদিক সোমনাথ নন্দী আমায় নানা ভাবে গাইড করেছিলেন ।

সকাল সকাল বের হয়েছি যাব বিনপুরের দিকে । বিনপুর বললে কত কথা মনে পড়ে । এক সময় এই বিনপুর কে বলা হত বাংলার কালাহান্ডি । সেই সময় আমি সাংবাদিকতা করতাম সেই সুবাদে গিয়েছিলাম বিনপুর । দুর্ভিক্ষ আর হাহাকার এর ছবি দেখে আতঙ্ক লেগেছিল । আজ সে বিনপুর কত সুন্দর কত রঙিন ঘরে ঘরে মুরগি , ছাগল । বাড়ির আশেপাশে সেজে উঠেছে ধানের সোনালীডানা । গ্রাম দিয়ে যে শহরকে ঘিরে ফেলা যায় সে কথা আবার নতুন করে মনে হয়েছে । অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে বিনপুর, বেলপাহাড়ি ,লালগড় , কাকড়াঝোড় । এ যেন মাওবাদী সার্কিট ! ! আজ আমাদের ভ্রমণ সেই পথেই ।

‘গাছটির নাম হীরা/ তায় ধইরেছে গুড় বাইগন জিরা ‘ কি নাম এই গাছটির ? এই ধাঁধার উত্তর আমি জানতাম না । যদি না যেতাম ঝাড়গ্রাম কোনদিনই জানতাম না গাছটির নাম কি ? ধামসা মাদলের দেশে এসে মনে হয় কত কিছুই আজানা রয়ে গেল জীবনে। মহুয়া গাছকে বলে হীরা। আদিবাসী জীবনের মূল স্রোতে রয়েছে হীরার বিচরণ । ঝাড়গ্রাম থেকে কিছুটা গেলেই শুরু হয়ে গেল মহুয়া গাছের অতল ছায়া । যাচ্ছি কনক-দুর্গা মন্দির দেখতে । রাজা গোপিনাথের কথা আমার মাথায় আছে । মন্দিরের কাহিনীতে নরবলির কথা বলা হয়েছিল ।সেটা শোনার পর আমার গা গুলিয়ে ওঠে । মনে মনে ভাবি এখানে না গেলেই হয়তো ভালো ছিল । সে বলে চলো একবার মাটির রং দেখে আসি। শরতের আকাশে তখন আঁকাবাঁকা মেঘ । কাল রাস্তা। শাল গাছের জঙ্গলে বাসা বেধেছে কুড়কুটের ডিম। যা একদিন ছিল আদিবাসী মানুষদের প্রধান খাদ্য (অভাবে )। কুড়কুটের ডিম (এই অঞ্চলের ভাষা) আসলে লাল পিঁপড়ের ডিম । যা দিয়ে মাছ ধরার টোপ বানান হয় । শাল গাছ যত সঙ্ঘবদ্ধ , মহুয়া গাছ কিন্তু ততটা সঙ্ঘবদ্ধ নয় । রাস্তার দুধারে নিজের মতো করেই বেড়ে উঠেছে এই গাছ গুলো ।যেখানে বড় গাছ নেই সেখানে আধা পাকা ধানের শীষে হৈমন্তিক গন্ধ । সবুজ আর হলুদের এ এক অদ্ভুত মিশ্রণ !

মূল রাস্তা থেকে হঠাৎ ডান দিকে বেঁকে গেল রাস্তা, এখান থেকে যেতে হবে মন্দিরের দিকে । গাড়ি যেখানে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিল সেখান থেকে যেতে হবে আরও ১০ মিনিট হেঁটে মন্দিরে । রাস্তার দু’পাশে বোটানিকাল পার্ক । দূরে দেখি দুটো হাতি দাঁড়িয়ে আছে চকিতে চমকে উঠি । বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে দেখি না না এটা আসল নয়। রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় আসল নকল সব একাকার হয়ে গেছে । মন্দিরের সামনে যাই । দূর থেকে কনক দুর্গার মূর্তি দেখি। নতুন ভাবে তৈরি হয়েছে মন্দিরটি । পুরনো মন্দির জীর্ণ অবস্থা তারই পাশ দিয়ে নেমে গেছে রাস্তা ডুলুং নদীর তীরে । আমিও নেমে যাই। নদী মানেই স্রোত,নদী মানেই টান । এই নদীতে মাঝি মাল্লার গান নেই । নৌকা চলে না । শান্ত দুপুরে ছিপ ফেলে বসে থাকা অনন্ত সময়ের টানে । নদীর কোন উৎস নেই, বর্ষার জলে ভেসে থাকা নদী । কিন্তু তার গতিবেগ বড় প্রবল । জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে আবার যেন জঙ্গলে প্রবেশ করছে । লাল মাটির দেশে জলের রঙ পান্নার মতো । মতো শব্দটা ঠিক হলো না। পান্না বলাটাই ঠিক। পা ভিজিয়ে দি। বালি খুঁজি। এঁটেল মাটি পা কামড়ে ধরে। ভাবি এখানে আমার বাড়ি থাকলে একটা নৌকা বানাতাম। নদীর কোন হাঁক ডাক নেই। জীবনের মতো নিস্তরঙ্গ বয়ে চলেছে ।
কনক দূর্গা মন্দির দেখে সেখান থেকে চলে যাই চিল্কিগড়ের রাজবাড়ি দেখতে।

কিভাবে যাবেন : হাওড়া থেকে প্রতিদিন সকাল ৬ টা ৩৫ ও বিকেল ৫ :২৫ টাটা ইস্পাত এক্সপ্রেস যাচ্ছে। ঝাড়গ্রাম যেতে মাত্র ২:১৫ সময় লাগে। এছাড়া ধর্মতলা থেকে সরাসরি বাস যাচ্ছে ঝাড়গ্রাম।
কোথায় থাকবেন : রাজার মতো থাকতে গেলে ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে থাকতে পারেন। রাজ বাড়ির পাশে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের সুন্দর থাকার জায়গা আছে । এই দুটো বুকিং করতে পারেন অনলাইনে। এছাড়া ছোট-বড় নানা মাপের হোটেল রয়েছে ঝাড়গ্রামে।
হোটেলের জন্য ও ভ্রমণ গাইডের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন অরিন্দম দত্ত : ফোন +918101421170