বহুবর্ণে, বহুনামে ও বহুরূপে আঞ্চলিক দুর্গা
ড.সুজয়কুমার মন্ডল
অধ্যাপক, লোকসংস্কৃতি বিভাগ, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলার ঘরে ঘরে এখন পারস্পরিক শারদ শুভেচ্ছা জানানোর মরশুম চলছে। করোনার আবহকালেও শারদোৎসবের উন্মাদনা কম ছিলনা। বাঙালি তার দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ কষ্ট ভুলে মা দুর্গার আরাধনা ব্যাপ্ত থেকে কামনা করেছে সুদিনের আশায় এবং সার্বিক মঙ্গলের। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে দেবী বহুভুজাকে বহুমূর্তি, বহুবর্ণে, বহুরূপে ও বহুনামে পূজিত হতে দেখা যায়। এই মাতৃশক্তির দেবীরূপে কল্পনার নেপথ্যে প্রজনন বা উর্বরতা সংক্রান্ত বিশ্বাস অত্যন্ত প্রকট। আমাদের দেশে মাতৃদেবীর রূপ কল্পনায় অবৈদিক বা প্রাক্-বৈদিক বিশ্বাস ও কল্পনা ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছে। একইসঙ্গে প্রভাব ফেলেছে আঞ্চলিক লৌকিক রীতিনীতি ও প্রথা। কাজেই মা দুর্গার আরাধনাতে শাস্ত্রীয় অলৌকিক রীতিনীতি মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়।
প্রধানত, কৃত্তিবাসের প্রভাবেই বাংলার লোকসমাজে বহুল প্রচলিত শস্য উৎসব রামায়ণের রামচন্দ্রের অকালবোধন হিসেবে রূপলাভ করেছে। এই রীতি শারদীয়া দুর্গোৎসব হিসেবে প্রচলিত। দুর্গা পূজা সম্পর্কে আরেকটি অতিপরিচিত ধারণা হলো, এটি বসন্তকালের পূজা, যা জনসমাজে বাসন্তী পূজা নামে পরিচিত। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে রাবণ বধের জন্যই রামচন্দ্র প্রথম শরৎকালের অকালবোধন রূপে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। এখনো পর্যন্ত শরৎকালের এই অসময়ে পুজো অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা বা শারোদৎসব নামে প্রচলিত। পণ্ডিতদের অনেকেই এই অভিমত সম্পর্কে ভিন্ন মত ব্যক্ত করেন। কারণ, বাল্মিকী রামায়ণ ও তুলসীদাস রামায়ণে রামচন্দ্রের অকাল বোধনের প্রসঙ্গ নেই। শুধুমাত্র কৃত্তিবাসের রামায়ণেই তা দেখা যায়। উপনিষদে দেবী দুর্গার কাত্যায়নী ও কন্যাকুমারী নামের উল্লেখ রয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে মা দুর্গা শাকম্ভরী নামে অভিহিত হয়েছেন। ভগবতী নামেও দেবী জনসমাজে পূজিতা হন। হরিবংশ দেবী দুর্গা বিন্ধবাসিনী এবং শবর পুলিন্দ বর্বর প্রভৃতি অনার্য জাতির দেবী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন। কিরাত জাতির দেবী দুর্গা বা চন্ডী। এইজন্যই চণ্ডীর অপর নাম কিরাতিনী। আদিবাসী সমাজে দেবী চণ্ডী পূজিতা হন।
মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গাকে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। দেবী দুর্গার সপারিবারিক মৃন্ময় মূর্তির পূজা বাংলার সম্পদ। এখন অবশ্য শুধু বাংলার নয়, বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাঙালিরা যেখানেই অভিবাসন করে বসবাস করছেন, সেখানেই তাঁরা দেবী দুর্গার আরাধনা করেন। দিনে দিনে এই রীতি ক্রমশই বাড়ছে।
শারদোৎসবে আঞ্চলিক লৌকিক রীতির প্রভাব অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। মূর্তির গঠন, বর্ণ, রূপ ও পূজা-পদ্ধতিতে লৌকিক চরিত্র খুব সহজেই অনুধাবন করা যায়। আঞ্চলিক রূপ হিসেবে পটে আঁকা দুর্গা জনসমাজে পূজিত হন। আর মৃন্ময় মূর্তির ক্ষেত্রে দেবী দুর্গার নানা বর্ণ দেখা যায়, কোথাও নীল, কোথাও রক্তবর্ণ, আবার কোথাও সবুজ। এছাড়াও হলুদ, হালকা গোলাপি এবং স্বাভাবিক মানব-গাত্রের উজ্জল বর্ণও পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি বর্ণের নেপথ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য রয়েছে। সেই আলোচনায় না গিয়ে, এবারে কয়েকটি আঞ্চলিক নামের দুর্গার কথা উল্লেখ করা যাক।
আমরা পশ্চিমবঙ্গকে যদি ভৌগোলিক অঞ্চলগতভাবে দুটি অংশে ভাগ করে নি তাহলে তার এক একটি অংশ হবে দক্ষিণবঙ্গ এবং অপর অংশটি হবে উত্তরবঙ্গ। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় নানা নামে দেবী দুর্গা পূজিতা হয়ে আসছেন। যেমন, নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমল থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে দেবী দুর্গা রাজরাজেশ্বরী রূপে প্রাচীনকাল থেকে পূজিতা হয়ে আসছেন। এখানে বোধন হয় মহালয়ার আগে। প্রতি বছরের মতো এবারেও কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির নাটমন্দিরে রাজরাজেশ্বরীর পূজা হয়েছে। এই পূজা আজ কালের নিয়মে ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে উঠেছে। নদীয়ার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে নস্করী মাতা হিসেবে মা দুর্গা আরাধ্য হন। করিমপুর ১ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত হুগোলবাড়িয়া অঞ্চলের নস্করীতলায় নস্করী মাতার মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল ৯৫০ বঙ্গাব্দ। কাজেই প্রায় ৫০০ বছরের প্রাচীন হতে চলল এই পূজা। একসময় ওপার বাংলা থেকে অনেকেই পুজো দেওয়ার জন্য এখানে আসতেন। পূর্বের মতো এখনো অষ্টমীর দিন প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। অনেকেই জাগ্রত দেবী হিসেবে নস্করী মাতাকে ভাবেন। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তবঙ্গের ঝাড়গ্রাম অঞ্চলের চিল্কিগড়ে কনক-দুর্গা নামে দেবী দুর্গা পূজিত হন। লালমাটির রাঢ় বাংলাতেও দেবী দুর্গার নানান নামের প্রচলন রয়েছে। দৃষ্টান্ত না বাড়িয়ে আর দুটি প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করব। একটি হলো বনদুর্গা এবং অপরটি হলো উত্তরবঙ্গের রাজবংশী জনসমাজের পূজিতা দেবী ভান্ডারী বা ভান্ডানি বা ভান্ডারনি।
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলে বনদুর্গা পূজার প্রচলন রয়েছে। এই পূজা উপলক্ষে বনদুর্গার গানও হয়। বনদুর্গা গাছের মধ্যে অধিষ্ঠিত থাকেন, সেই জন্য ব্রতিনীরা গাছের ডালে শাঁখা- সিঁদুর, আয়না-চিরুনি ও নানান ধরনের উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তোলে। এই দেবীর পুজোয় হাঁসের ডিম দেওয়ার প্রথাও জানা যায়। আবার কোথাও কোথাও অরণ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে পৌরাণিক দুর্গার লৌকিক রূপ হিসেবে বনদুর্গার পূজা হয়।
মহাদশমী শেষ হতেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বসবাসকারী রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষেরা দেবী দুর্গার অন্যরূপ ভান্ডারী বা ভান্ডানি দেবীর পূজায় মেতে ওঠেন। এখানেও বনদুর্গা হিসেবে ভান্ডারী দেবীর পূজা হয়। এই পূজার প্রচলন শুরুর প্রসঙ্গে জনশ্রুতি রয়েছে যে, দশমীতে উত্তরের জঙ্গল পথ ধরে কৈলাসে ফেরার সময় মা উমার পথ আটকে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষেরা তাঁকে আরধনা করার আকুতি জানায়। দেবী তাঁদের ভক্তি দেখে পূজা নিতে রাজি হন। এভাবেই ভান্ডারী দেবীর পূজার চল হয়েছে বলে রাজবংশী সম্প্রদায়ের মানুষদের বিশ্বাস। এছাড়াও অন্যান্য জনশ্রুতিরও প্রচলন রয়েছে। জানা যায় পূর্বে এই দেবী ব্যাঘ্র বাহিনী ও রক্তবর্ণ ছিলেন কিন্তু বর্তমানে সিংহ বাহিনী হিসেবে পূজিত হন। আরেকটি ক্ষেত্রেও আঞ্চলিক বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। মৃন্ময় মুক্তির ক্ষেত্রে ভান্ডারী কোথাও দ্বিভূজা, কোথাও চতুর্ভূজা, আবার কোথাও অষ্টভূজা। যেমন জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি অঞ্চলে দ্বিভূজা ভান্ডারী দেবীর পূজা হয়। সঙ্গে থাকে লক্ষ্মী, সরস্বতী কার্তিক ও গণেশ। মহিষাসুরমর্দ্দিনীর মতো এখানে কিন্তু মহিষাসুর ও মহিষ থাকেনা। মূর্তির গঠনের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষত্ব। অতীতে থানে ভান্ডারী দেবীর পূজা হত, অর্থাৎ কোন মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল না। মূলত তিস্তা-তোর্সা ও সংকোশ নদী বিধৌত অঞ্চলে এই দেবী পূজিত হন। পশু ও পাখি বলি দেওয়ার প্রথাও প্রচলিত রয়েছে। এই পূজাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে, ফলে উত্তরবঙ্গের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরে এই পূজার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
আঞ্চলিক রূপ, রীতি ও প্রথার বৈচিত্রে মাতৃশক্তির উৎসব শারদোৎসব বাংলা জুড়ে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে। আপামর বাঙালি সমাজ এই জাতীয় উৎসব পালনের মধ্য দিয়ে স্বজাত্যবোধের সত্তা বারে বারে খুঁজে পায়।
Thanks for the good article, I hope you continue to work as well.Спаситель на продажу