অন্য পুজো দেখা, এবার পূজায় বাহন দেখা
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়
এরা কারা? কেনই বা এলেন? না দুর্গার ছেলে মেয়েদের কথা বলছি না। লক্ষ্মী , সরস্বতী , কার্তিক, গণেশ এত মায়ের ছেলে মেয়ে । এদের তো সঙ্গে আনতেই হবে কিন্তু তাদের সাথে যারা আছেন তারা কেন এসেছেন ? এই তারা আসলে কারা ? এর তারা হচ্ছেন পেঁচা, ময়ূর, হাঁস , ইঁদুর, সিংহ । লক্ষ্মী ,সরস্বতী, কার্তিক,গণেশ এঁদের বাহন। বাহন বলতে আমরা বুঝি গাড়ি। এতো বড় গণেশ তার বাহন কী করে হতে পারে একটা ছোট্ট ইঁদুর! এতো বড় ঝাঁ চকচকে পূজামণ্ডপে তাদের কী অস্তিত্ব ? কে তাদের দেখতে যায় ? লক্ষ্মীর পেঁচার মিটিমিটি হাসি ,দুষ্টু চাহনি আমরা খুব একটা দেখতে পাইনা বা চাইনা । এরা বাহন নাকি মাস্তানের বাউন্সার ? এই সব বডি গার্ডরা কী ভাবে রক্ষা করবেন দেব দেবীদের? বড় খটকা লাগে এসব প্রশ্নের ? দেবী দুর্গা যে দুর্গতিনাশিনী সে তো আমরা সবাই জানি । লক্ষ্মী বিপদে পড়লে বা কার্তিক বিপদে পড়লে ময়ূর আর পেঁচা এই গাছ থেকে ও গাছের পালিয়ে যাবে । ইঁদুর গর্তে ঢুকে যাবে । আর হাঁস ? নদীতে চড়বে চই চই !!
শরতের আকাশে পেঁজা তুলোর মেঘ , শিউলি ফুল দু-একটা ফুটেছে সবেমাত্র । সেভাবে এখনো শিশির পড়া শুরু হয়নি । দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গেছে । প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে দেবী সহ সকলেরই আগমন ঘটে যাচ্ছে । আমরাও বেরিয়ে পড়বো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত । এবার আর মা দুর্গা কে দেখব না, দেখবো তাদের ছেলেমেয়েদের বাহনদের। এই বাহনরাই আসলে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রেখেছে। দেবতাদের পাশে তাদের বসিয়ে রাখার অন্যতম কারণ যাতে তাদের হত্যা করা না হয় । দেবতা জ্ঞানে একবার যদি তাদের পুজো করা হয় তাহলে তাকে হত্যা করা বড় পাপ । সব দেব দেবীর একটি করে বাহন আছে । মনসা দেবীর সাথে জড়িয়ে আছেন সাপ । বিষ্ণুর বাহন গরুড়। বরাহ কূর্ম গাভী ইত্যদি প্রভৃতি সবই দেবতাদের সাথে জড়িয়ে রাখা হয়েছে । পুরাণের পথে যদি হাঁটা যায় তা হলে দেখা যাবে প্রায় সমস্ত জন্তু -জানোয়ারে সাথে দেবতা জড়িত ।
আমাদের কবি বন্ধু মৃদুল দাশগুপ্ত একবার লিখেছিলেন সরস্বতীর হাঁস সেও কী এম এ পাস ? মৃদুলদা বড় কঠিন প্রশ্ন করে ফেলেছিল ? সরস্বতী এমনিতেই রোমান্টিক গান বাজনা নিয়ে থাকেন পড়াশোনা করেন । যে কেউ তার প্রেমে পড়ে যেতে পারেন ! তার বাহন হাঁস । কেন? কেনই বা তাকে বাহন করা হল? এবার আর পাড়ার প্যান্ডেলে নয় যেতে হবে পৌরাণিক প্যান্ডেলে । যেখানে দেব-দেবীদের বাস সেখান থেকেই শুনে আসতে হবে তাদের কাহিনী । পুরাণ বলে ব্রহ্মা সরস্বতির রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিবাহ করতে উদ্যত হন। ভীত দেবী একটি হাঁসের রূপ ধারণ করেন। পরে সেটাই বাহনে রূপান্তরিত হয়েছে বলে অনুমান। শিক্ষিত মানুষেরা কি করেন ? খারাপ জিনিস টা কে সরিয়ে দিয়ে ভালো জিনিসটা গ্রহণ করেন । দুধ আর জল মিশিয়ে দিলে হাঁস কিন্তু দুধ পানই করে ।
লক্ষ্মীঠাকুর এত সুন্দর দেখতে আর পেঁচার মত দেখতে পেঁচা । আসলে পেঁচা হল একটি প্রতীক। লক্ষ্মীর অসীম ঐশ্বর্যের দিকে তার কোনও লক্ষ্য নেই। সে আসলে উদাসীন। জাগতিক সমস্ত চাওয়াপাওয়া থেকে সে নিজেকে সরিয়ে রাখে দূরে।
‘ইন্দ্রের রাজসভায় ক্রৌঞ্চ নামে এক গায়ক ছিলেন। অহঙ্কারে ক্রৌঞ্চ একদিন অপমান করে বসলেন বামদেব নামের এক ঋষিকে। ঋষির গলায় সুর ছিল না, তাও তিনি গান গাইছিলেন। এতেই ঠাট্টা করে ক্রৌঞ্চ। ক্রুদ্ধ, কুপিত বামদেব বললেন যে সৌন্দর্য ও গুণের জন্য তাঁর এত অহঙ্কার সে সব কিছুই থাকবে না। ক্রৌঞ্চ পরিণত হলেন এক ছোট্ট কদাকার ইঁদুরে। মর্তে এসে ঋষি পরাশরের আশ্রমে আশ্রয় নিলেন ক্রৌঞ্চ। সেখানেই একদিন গণেশের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল তাঁর। গণেশ সব শুনে ক্রৌঞ্চকে নিজের বাহন করে নিলেন। বিশাল গণেশের সামনে ছোট্ট ইঁদুর থাকার অর্থ হল নিজের অহঙ্কার, ক্রোধ ও অনান্য তামসিক গুণের উপর নিয়ন্ত্রণ। ‘
কার্তিকের বাহন কেন ময়ূর হল পৌরাণিক প্যান্ডেলে গিয়ে আমি খুঁজে পাইনি । তবে কিছু কিছু অনুমান করা যায় । কার্তিক হলেন সুন্দর সেনাপতি । ময়ূর কম সুন্দর নয় । দক্ষ সেনাপতির পাশে দক্ষ পাখিকেই মানায়। ময়ূর কিন্তু খুব সতর্ক পাখি । ঘুম কম । সর্বদাই সেনাপতির পাশে জেগে থাকেন ।
আর রহিলেন মা দুর্গার বাহন সিংহ। অসুরকে নিধন করার জন্য সমস্ত দেব-দেবীরা শক্তি প্রদান করেছিলেন দেবী দুর্গাকে । তাদের মিলিত শক্তির একটি রূপ সিংহ ।
চলুন আবার মর্ত্যের প্যান্ডেলে এসে তাদের দেখে নেওয়া যাক ।