গ্রামের পুজো
বামাপদ গঙ্গোপাধ্যায়, পর্যটক বিশেষজ্ঞ
তখন আমি ২১ বছরের যুবক । একা একা ভ্রমণে যাই কাছে পিঠে । পুজোর সময় কোন দিনই বাড়িতে থাকিনি । পুজোর আগেই একটা গন্ধ পাই পুজোর । কোথাও না কোথাও ভ্রমণে যাবই । মাথায় ঘুরছিল এবার গ্রামে পুজো দেখতে যাব । শুধু পুজো নয় , পুজোর কটা দিন সেখানেই থাকবো । এরকম একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল । চেনা শুনো বাড়ি না পেলে থাকবোই বা কোথায় আর দু বেলা পাত পেড়ে কে-ই বা খেতে দেবে ? যেখানেই যাব সেটা ট্রেন হতে হবে । কেননা ট্রেন ছাড়া বিনা পয়সায় কেউ নিয়ে যাবে না । সে রকম জায়গার আমার নেই। তাই চিন্তাটা মাথা থেকে বের করে ফেললাম। বেশ কয়েক দিন পরে বাড়িতে একটা চিঠি এলো। যাকে আমি চোখে দেখিনি কিন্তু চিনতাম । চিঠিতেই চিনতাম সেই বান্ধবীকে । সে চিঠিতে জানিয়েচে : আপনি পুজোর সময় আমাদের এখানে আসুন , সঙ্গে কিছু কবিতা নিয়ে আসবেন । চিঠিটা পেয়ে বুকের ভেতরটা কেমন যেন চিন চিন করে উঠলো । যেতেই হবে । কিন্তু কেন যাব, কবিতাই বা কোথায়? সেটা আর কাউকে বলতে পারছি না। কি এক অসহায় বোধ কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে । দেবগ্রাম গিয়ে ফিরে আসা সেও বেশ দুষ্কর । বান্ধবীর বাড়িতে অবশ্যই আমাকে থাকতে দেবে না। এই সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে একদিন অসীম বিশ্বাস (চাকদহের ) আমার বাড়িতে এলো । কবি অসীম বিশ্বাস বঙ্কিম কলেজে পড়ত । ওর এক বন্ধু ছিল রামকৃষ্ণ সেন। সেও একই কলেজে পড়ত সেও আমার বন্ধু হয়ে যায় । অসীম এসে বল্ল পূজায় এবার কোথায় যাবে ? আমি বললাম, না সে রকম কিছু ভাবিনি। অসীম বল্লো : রামকৃষ্ণর বাড়ি যাচ্ছি তুমি যাবে ? এতো গাছে না উঠতেই এক কাঁদি । আমি জানি রামকৃষ্ণর বাড়ি যেতে গেলে দেবগ্রাম স্টেশনে নেমে যেতে হয় । এক কথায় রাজি হয়ে গেলাম । বান্ধবীকেও চিঠিতে জানিয়ে দিলাম আমি যাচ্ছি,সঙ্গে আর একজন কবি বন্ধুও থাকবে।
সপ্তমির দিন সকালে আমরা রওনা দিলাম । লালগোলা প্যাসেঞ্জার দেবগ্রাম স্টেশনে এসে থামল । বুকের ভেতরটা কেমন করছে । নেমেই তার দেখা পাবো! ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর শুনশান স্টেশন । কাউকে দেখতে পাচ্ছি না । কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করচে না তো ! তা হলে সে কি আমার চিঠি পাইনি ! হতাশ হয়ে পড়লাম , সপ্তমীতেই বুকে বিসর্জনের ঢাক বেজে উঠলো ! দশ মিনিট স্টেশনে অপেক্ষার পর আমরা মাটিয়ারি গ্রামে যাবার জন্য বাস ধরলাম ।
বাস একটু এগিয়ে যাবার পর গ্রামের নিজস্ব গন্ধটা নাকে আসছে । পাট ভেজানোর এই গন্ধটা আমার একদম সহ্য হয় না , আবার না পেলে গ্রামে এসেছি সেটাও মনে হয় না । সেন পাড়াতে এসে যখন পৌঁছলাম সন্ধ্যে হতে একটু দেরি আছে । রামকৃষ্ণদের বাড়ির পুজো । (এ বছর পুজোর বয়স হবে ১০৮ বছর ।) এই অঞ্চলে অনেকগুলো পুজো হলে কি হবে সেনবাড়ির পুজোর একটা মাহাত্ম্য আছে এবং প্রাচীনতম পুজো হিসেবে মানুষ গণ্য করে । সেনপাড়া এই অঞ্চলের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম । রামকৃষ্ণদের বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম হয়েছে । রামকৃষ্ণ আমাদের নিয়ে গেলে তার ঘরে । এটাই এখন আমাদের ঘর। ঠাকুরের মুখ এখনো দেখা হয়নি ,তবে ঢাকের শব্দ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে । ফ্রেশ হবার পর আমরা নেমে এলাম ঠাকুর দালানে । সেন পরিবার বেশ বড় পরিবার । ঠাকুর দালানে অনেক মানুষ । সকলেই যেনো ব্যস্ত । পুরোহিত মশাই চামুন্ড নেড়ে চলেছেন । ধুনোর গন্ধ ম ম করচে । ঢাক আর কাসরের যুগল বন্দীতে বাচ্ছারা যেনো নতুন একটা চেনা জগৎ খুঁজে পেয়েছে । রামকৃষ্ণ মা এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । সবাই কে আমি হা করে দেখছি । বাড়ির মেয়েরা নতুন যেমন পোশাক পড়েছেন তেমনি সোনা দিয়ে হাত গুলো মুড়ে রেখেছেন । মনে হচ্ছে এক একটা পরী ।
কাল অষ্টমীর ভোগ হবে । তার আয়োজন চলছে । একদিকে নাড়ু করছেন বাড়ির লোকজন , অন্যদিকে চলছে সবজি কাটা । ২০০ মানুষের আয়োজন । এলাহী ব্যবস্থা । মাটিয়ারি গ্রামটি বিখ্যাত কাঁসার শিল্পের জন্য । এই গ্রামে রয়েছে রামসীতা মন্দির । এই গ্রামের মানুষ রামরেনু বন্দ্যোপাধ্যায় বহু বছর আগে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন । বলা যেতে পারে নিজের মত রামায়ণকে আবার লিখেছিলেন । সেই পুঁথির পাণ্ডুলিপি এখনো ব্যানার্জি বাড়িতে আছে । আমার দেখা হয়নি ।
অষ্টমীর সকাল । অঞ্জলি দেবার দিন। আমরা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেখি সকলেরই স্নান হয়ে গেছে । ছেলেরা সবাই ধুতি পরেছে । আমাদের ধুতি নেই । আমি ব্যাগ থেকে খদ্দরের একটা পাঞ্জাবী বের করে পড়ে নিলাম ।গ্রামের মানুষ ভেঙে পড়েছে ঠাকুর দালানে । এতো মানুষকে একসাথে অঞ্জলি দিতে এর আগে দেখিনি । সেদিন দুপুরে দেখেছিলাম, মানুষের ভক্তি আর আনন্দ এক সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । বিকেলে নিজেরাই বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের পুজো দেখতে । শান্ত নিরীহ পুজো চারিপাশে । সকালে একটু বৃষ্টি হয়েছে কাদা কাদা ভাব চারিদিকে । তারই মাঝে পদ্ম ফুলের পাঁপড়ি পড়ে আছে রাস্তায় । মেলা মেলা ভাব । জিলিপি আর পাপড় ভাজার গন্ধ চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্যান্ডেলের কোন চাকচিক্যতা নেই,আছে শুধু ভক্তি । দুপুর ১২টার পর থেকে সন্ধিপুজো। ফলে এবার উপবাসের ক্ষেত্রে অনেকেই বেছে নেন ২টি পুজোকেই। অষ্টমী পুজোয় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার পর উপবাস বজায় রেখে সন্ধিপুজোয় পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার সুযোগটা অনেকে কাজে লাগান। প্যান্ডেলে লোক জন কম । আমাদেরই সবাই দেখছে ।
দশমীর দিন বাড়ি চলে আসব । এরকমই ঠিক ছিল । কদিন ধরে আড্ডা আর আড্ডায় কখন যে সময় কেটে গেছে বুঝতে পারিনি । বাড়ির লোক, গ্রামের লোক সবাই আপন হয়ে গেছেন । বাড়ির গৃহকর্তী আমাদের কিছুতেই আসতে দিলেন না । সকাল থেকে বিসর্জনের বাদ্য বেজে চলেছে । দুপুর থেকেই নানা আয়োজন, সিঁদুর খেলা বরণডালা সাজানো চলছে । দেবীকে বের তোলা হবে নৌকায়। সে এক বিরাট কর্মযজ্ঞ । পরপর তিনটি নৌকাকে একসাথে বাঁধা হলো, তারপর সেই নৌকায় তোলা হলো দেবী দুর্গাকে । আমরাও চলমান নৌকায়। গঙ্গায় শুরু হলো বিসর্জনের লড়াই । নদীয়া বনাম বর্ধমান । আমরা আছি নদীয়াতে। চারিপাশে শুধু নৌকা আর নৌকা । মানুষজন এসেছেন নৌকা করে বিসর্জন দেখতে । গঙ্গার উল্টো দিক হলো দাঁইহাট । আতশবাজিতে ভরে উঠেছে গঙ্গায় । দুর্গাকে সাজানো হয়েছে নানা ভাবে ,কাদের ঠাকুর সবচেয়ে ভালো হয়েছে সে নিয়ে মুখে মুখে লড়াই । সে এক উন্মাদনা মেতে উঠি আমরা, যেকোনো মুহূর্তে ঘটে যেতে পারত দুর্ঘটনা । আমি ভয়ে কোনরকমে গণেশের ইঁদুরকে ধরে বসে আছি । সব বিসর্জন হয়ে গেল আমি কিন্তু পকেটে করে এক টুকরো ইঁদুর নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম ।
মন ভালো করা একটি লেখা।